}; এসআইদের অব্যাহতি, যাচাই-বাছাই ও নেতিবাচক সংস্কৃতি

এসআইদের অব্যাহতি, যাচাই-বাছাই ও নেতিবাচক সংস্কৃতি

 এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই আন্দোলনটি মূলত শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বৈষম্য দূর করার দাবিতে। তরুণেরা কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই সরকারি চাকরি পেতে চায়। তাদের এই সুদৃঢ় অবস্থান থেকেই এক চরম স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে। তবে এর পরই পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত এসআই ব্যাচের অনেক সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায় বৈষম্যের অভিযোগ ওঠে।

SI, Gen Alpha News
পুলিশের ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত আট শতাধিক সাব-ইন্সপেক্টর বা উপপরিদর্শক (এসআই) নিয়োগের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে আড়াই শতাধিক উপপরিদর্শককে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং আরো অর্ধশতাধিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

একাডেমি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী, এসব এসআইরা নাশতা না খেয়ে মাঠে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, একাডেমি কর্তৃপক্ষকে অবমাননা করে এবং ক্লাসে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। তবে পুলিশের বেশ কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে একাডেমিতে শৃঙ্খলাভঙ্গের বিভিন্ন ঘটনা ঘটে, যা সাধারণত কঠোর আবাসিক অনুশীলনের মধ্যে অনেক ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এ ক্ষেত্রে অভিযোগগুলোও খুব গুরুতর নয়।

ঢাকায় কর্মরত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিসিএসের মাধ্যমে এএসপি এবং সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত সার্জেন্টদের জন্য 'ইন সার্ভিস ট্রেইনিং' থাকে এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে কনস্টেবল ও এসআইদের ক্ষেত্রে চাকরিতে যোগদানের আগে প্রশিক্ষণ শেষ করতে হয়, ফলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে চাকরির বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।

ভুক্তভোগী কয়েকজনের সাথে কথা বলার পর জানা গেল, প্রকৃতপক্ষে এখানে কোনো গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা ঘটেনি। ২০ অক্টোবর বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের (এএসপি) পাসিং আউট অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ৩০ অক্টোবর থেকে তাঁদের কুচকাওয়াজের অনুশীলন শুরু হয়।

তবে প্রচণ্ড গরমে কঠোর অনুশীলনের সময়ে বিরতিতে মাঠের পাশেই ছোলা এবং ডিম পরিবেশন করা হতো। এ খাবারে অনেকের পেটে গোলযোগ দেখা দেয়। ছোলার বাটিতে চামচ না থাকা, হাত ধোয়ার পানি না থাকা ইত্যাদি কারণে খাবার পরিবেশনা নিয়ে একধরনের অসন্তোষ সৃষ্টি হয় প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে।

১ অক্টোবর প্রায় ছয় শতাধিক প্রশিক্ষণার্থী খাবার বর্জন করেন। একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাঁদের সাথে কথা বলে এবং একদিন পর থেকে খাবারের মেনুতে পরিবর্তন আনে।

৭ অক্টোবর অনুশীলনের সময় আড়াই শতাধিক উপপরিদর্শককে আলাদা করে ফেলা হয় এবং তাঁদের তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তাঁরা যথাসময়ে নোটিশের উত্তর জমা দেন। এরপর তাঁদের পাঁচ দিনের ছুটিতে বাড়িতে পাঠানো হয়। ছুটিতে থাকা অবস্থায় তাঁরা জানতে পারেন এবং চিঠির মাধ্যমে জানানো হয় যে তাঁদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এখন তাঁদের প্রশ্ন—প্রতিবাদ তো সবাই করেছিল, তাহলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ কেন শুধু আড়াই শতাধিকের বিরুদ্ধে আনা হলো? সবার ক্ষেত্রে কেন একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না?

বিএনপির অভিযোগ, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষিতে... বিএনপি দাবি করে যে সারদায় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আড়াই শতাধিক এসআইকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। ১৭ অক্টোবর বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা জানান যে ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পুলিশ প্রশাসনে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে একটি বৃহৎ সংখ্যক এসআই নিয়োগ দিয়েছে, যেখানে অনেকেই গোপালগঞ্জের বাসিন্দা বা ছাত্রলীগের সদস্য। তিনি এসব নিয়োগ বাতিলের দাবি জানান।

ঢাকায় র‍্যাবে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার মতে, অনেকে অতীতে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সরাসরি ছাত্রলীগের সাথে না থাকলেও তাঁদের পরিবার বা ঘনিষ্ঠ কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। ফলে এসআই পদে তাদের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

আরেকজন ভুক্তভোগী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে তিনি ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত থাকলেও পরে রাজনীতি থেকে সরে আসেন এবং পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারে মনোনিবেশ করেন। চট্টগ্রামের আরেকজন ভুক্তভোগী, যিনি নিজ উপজেলা ভিত্তিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, জানান যে তিনি বিভিন্ন সময়ে তাঁর এলাকার সংসদ সদস্যের সাথে যোগাযোগ করতেন; শুধু এ কারণে তাঁর অব্যাহতি হওয়া উচিত নয় বলে দাবি করেন তিনি।আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীও বলেন যে তারা দুর্নীতি বা ঘুষের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তাদের অনেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, যারা কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতায় এত দূর এসেছেন।

পুলিশ বাহিনীর এই সাম্প্রতিক ইস্যুতে, যেখানে ৪০তম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী সাব-ইন্সপেক্টরদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেটি নিয়ে বিভিন্নমুখী বিতর্ক চলছে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, তাদের কিছু শৃঙ্খলাভঙ্গের কর্মকাণ্ডের জন্য বাদ দেওয়া হয়েছে, যেমন খাদ্য ও পরিবেশন ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ বা একাডেমির নিয়মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন। তবে কিছু ভুক্তভোগী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, অব্যাহতি দেওয়ার আসল কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক সম্পর্কিত।বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব এবং নির্দিষ্ট দলীয় সংশ্লিষ্টতার কারণে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ পর্বে বৈষম্যমূলক আচরণ হয়ে আসছে। এই ঘটনাগুলিতে মূলত দলীয়করণ, ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক সুপারিশ, ঘুষের অভিযোগ, এবং বাছাইয়ে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে এটিকে সাধারণ শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দোষারোপ করা হলেও বিভিন্ন সূত্রের দাবি মতে, নির্দিষ্ট দলের প্রতি আনুগত্য বা কোনো দলের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের ফলেই এসব অব্যাহতির সিদ্ধান্ত এসেছে।বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ব্যবস্থা দলীয়করণ ও ক্ষমতা নির্ভর করে এবং সঠিক সংস্কার না হলে পরবর্তীতেও এমন ঘটনা অব্যাহত থাকতে পারে।


Post a Comment

Previous Post Next Post