}; বাজারের তাপ: গরিবের খাদ্যতালিকায় পুষ্টির অভাব

বাজারের তাপ: গরিবের খাদ্যতালিকায় পুষ্টির অভাব

গোপীবাগ-মানিকনগর এলাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন ইয়াসমিন বেগম। রিকশাচালক স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে মানিকনগরের এক রুমের বাসায় থাকেন তিনি। চারটি বাড়িতে কাজ করে ইয়াসমিনের মাসিক আয় ৮,০০০ টাকা, আর স্বামীর দৈনিক রোজগার গড়ে ১,০০০ থেকে ১,২০০ টাকা। তবে, একদিন পর পর রিকশা চালানোর সুযোগ মেলে। ইয়াসমিন জানান, বাড়িভাড়া ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দিয়ে এই পাঁচজনের খাবার জোগাতে তাঁকে কঠিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

https://genalphanews.blogspot.com/

ইয়াসমিন বলেন, “আমরা দুইজনে মিলে মাসে ২৭-২৮ হাজার টাকা রোজগার করি। বাসা ভাড়া ও কারেন্ট-গ্যাস বিল মিলে ৯,০০০ টাকা দিতে হয়। তিন সন্তানের পড়াশোনায় ৭,০০০ টাকা লাগে। পাঁচজনের খাবারের জন্য হাতে থাকে ১০-১২ হাজার টাকা। এই বাজারে এত টাকায় সংসার চলে?” তিনি জানান, চালের দাম বেড়ে গেছে। মাছের মধ্যে পাঙাশ ও তেলাপিয়া কিনতেও কষ্ট হচ্ছে। “ডিমের কথা তো আর বলাই যায় না; ভাঙা ডিম কিনে যা কিছু খাওয়াই। তরকারি-শাক তো এখন বড়লোকের খাবার। আমাদের মতো গরিবের তিনবেলা খাবার জোগানোই এখন দুষ্কর।”

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুশান্ত সাহা, দুই সন্তান, বৃদ্ধ মা এবং স্ত্রী নিয়ে কমলাপুরে থাকেন। তিনি বলেন, “বেতন পাওয়ার পর বাসা ভাড়া, সন্তানদের স্কুল ও টিউশন ও যাতায়াতের খরচ আলাদা করে রাখি। মায়ের ওষুধ এবং চাল-ডাল-তেল কিনে ফেলি। এরপর হাতে যে টাকা থাকে, তা দিয়ে একজনের রোজগারে সংসার চালানো সত্যিই অসম্ভব। মাছ-মাংসের খাওয়া কমাতে হয়েছে, মাছের টুকরাও ছোট করতে হচ্ছে। দুধ-ডিমেরও খাওয়া অনিয়মিত হয়ে গেছে। অসহায় লাগে।

ইসলামপুর এলাকার ব্যবসায়ী মো. নাজমুল হক বলেন, "ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। গত কয়েক বছরে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, যার কারণে চাল, ডাল, তেল ও নুন কেনার জন্যই পকেট ফাঁকা হয়ে যায়। পরিবারকে মাছ-মাংস, ডিম-দুধ বা ফল খাওয়ানো খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এখন তো ডাল-ভাত, সবজি ও কমদামের মাছ খেয়ে দিন কাটানোও কঠিন হয়ে গেছে।"

পণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে ইয়াসমিন, সুশান্ত এবং নাজমুলের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টিকে থাকা দিন দিন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে, ফলে প্রয়োজনীয় অনেক খাবার তাদের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে।পুষ্টিকর খাবার মানে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ছয় ধরনের খাদ্য উপাদানের সমন্বয়। এর মধ্যে রয়েছে—শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ, পানি ও চর্বি। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন মানুষের প্রতিদিনের খাবারে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা, ১৫ শতাংশ প্রোটিন এবং ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ স্নেহজাতীয় খাবার থাকা প্রয়োজন। এর অভাব হলে তা স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদে কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার উপরও খারাপ প্রভাব পড়ে।বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ইউএসএআইডির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মা এবং শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। অর্থনৈতিক চাপের কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য খাদ্য কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে, ফলে পুষ্টির অভাব আরও বাড়তে পারে।ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রতিটি তিনজন শিশুর মধ্যে দুইজন সুষম খাদ্য সংকটে রয়েছে। এর ফলে শিশুদের প্রাথমিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। পুষ্টির অভাবের প্রধান কারণ হিসেবে খাদ্য কেনার ক্ষমতার অভাব এবং বাবা-মায়ের সচেতনতার অভাব উল্লেখ করা হয়েছে। 

৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৬ শতাংশ খর্বকায় এবং ৯.৮ শতাংশ কৃশকায়।এটি একটি গুরুতর পরিস্থিতি যা সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপজ্জনক। দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন যাতে শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজন মেটানো যায়।বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিকস ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক ডা. শামসুন নাহার নাহিদ বলেন, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমতা হারানোর কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খাদ্য তালিকা সংকুচিত করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে স্নেহ ও প্রোটিনের উৎস বাদ পড়ে পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। কায়িক শ্রমজীবীরা বেশি ভাত খাওয়ার দিকে ঝুঁকছেন, যা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশুদের পুষ্টির অভাব হলে তারা খর্বাকারে পরিণত হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। 

আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ জানান, মহামারি ও মুদ্রাস্ফীতি শিশুদের অপুষ্টির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তীব্র অপুষ্টির কারণে শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি ১১ থেকে ১২ গুণ বাড়ে, এবং দীর্ঘমেয়াদী অপুষ্টি তাদের উচ্চতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।পুষ্টিবিদ তামান্না শারমীন বলেন, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি সমাজের সুস্থতার জন্য উদ্বেগজনক।

Post a Comment

Previous Post Next Post